স্টাফ রিপোর্টার :
অবশেষে বিজয়ের হাসি হাসলেন রাজাকারপুত্র মাকসুদ হোসেন। বন্দর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকের এই প্রার্থী রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বিশাল জয়ের মাধ্যমে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলোচিত দুই প্রার্থী তাদের উভয়ের মোট ভোট মিলিয়েও ছুঁতে পারেনি মাকসুদকে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রশীদের চেয়েও ১৫ হাজার ৩৫ ভোট বেশী পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন এই রাজাকারপুত্র । প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরাগভাজন হয়েও রাজাকারপুত্র মাকসুদের এই ভোটের ফলাফল নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে বন্দর তথা গোটা নারায়ণগঞ্জে। অনেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগ নেতা রশীদের পরাজয়টাকে মেনে নিতে পারছেন না।
এদিকে, ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বড় চমক এসেছে। সানাউল্লাহ সানুকে ৬০৫ ভোট ব্যবধানে পরাজিত করে বন্দরের নতুন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মাইক প্রতীকের প্রার্থী মো. আলমগীর। তবে বিজয়ের মাধ্যমে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ ধরে রেখেছেন ছালিমা হোসেন। তিনি তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মাহমুদা আক্তারের চেয়ে ৩ হাজার ১৭২ ভোট বেশী পেয়ে পূনরায় বিজয়ী হয়েছেন।
জানা গেছে, ভোটের আগে নানা শঙ্কা থাকলেও গতকাল তুচ্ছ ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যতিত উল্লেখ যোগ্য অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বন্দর উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল থেকে ভোট কেন্দ্রগুলো অনেকেটা ভোটার শূন্য থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। শান্তিপূর্ন পরিবেশে ভোট দিতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ভোটাররা।
এদিকে, বড় কোনো সংঘাত না ঘটলেও সকাল ১১টার দিকে বন্দরের হাজী আব্দুল মালেক উচ্চ বিদ্যালয় ও ২৬নং কুশিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী গলি থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসে। বেলা ১২টার পর একই কেন্দ্রের পাশে আরও দুটি বিকট শব্দ পাওয়া যায়। এতে ভোটারদের মাঝে সাময়ীক আতঙ্ক দেখা গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাৎক্ষনিক তৎপরতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রুপে ফিরে আসে। তবে দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিরা ওই শব্দের উৎসের বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখেননি। যদিও খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি এবং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নেয়া প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের জটলা ভেঙে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন।
অন্যদিকে, পরাজিত প্রার্থী এমএ রশীদের পক্ষে জাল ভোট দিতে গিয়ে আটক হওয়া তার এক পোলিং এজেন্টকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। বিকেলে উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের লাউসার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইমরান মোল্লা ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে এই সাজা প্রদান করেন। সাজাপ্রাপ্ত পোলিং এজেন্টের নাম নাঈম ওরফে ওমর ফারুক। তিনি বন্দরের আসাদ মিয়ার ছেলে।
এছাড়াও মদনপুর ইউনিয়নের ৩৩ নম্বর কেওঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট চলাকালে আনারস প্রতীকের প্রার্থী মাকসুদ হোসেনের (বিজয়ী) এক পোলিং এজেন্টকে মারধরের অভিযোগ উঠে দোয়াত-কলম প্রতীকের পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী এম এ রশিদের সমর্থক আলী নূর ও তার কর্মীদের বিরুদ্ধে। মারধরের শিকার ওই এজেন্টের নাম মো. ফারুক। পুলিশের সামনেই তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয় বলে অভিযোগ করেছিলেন মাকসুদ হোসেনের নির্বাচন সমন্বয়কারী ইকবাল হোসেন। যদিও পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠে।
এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বন্দর উপজেলা নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সংঘাত দেখা যায়নি। ভোট চলাকালিন সময়েও প্রার্থীদের কেউ সংঘাত বা অনিয়মের অভিযোগ করেননি। এছাড়াও ভোট গ্রহণের পর ফলাফল ঘোষণার সময়েও কোনো প্রার্থীর সমর্থকদেরকে সংঘাতে জড়াতে দেখা যায়নি।
বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলে ৫৪টি কেন্দ্র থেকে কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে ব্যালট বাক্স নিয়ে উপজেলা পরিষদে আসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসাররা। গণনা শেষে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে উপজেলা অডিটরিয়ামে একেএকে ৫৪টি ভোট কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা শুরু করেন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন অফিসার ইস্তাফিজুল হক আকন্দ।
এদিকে, ফলাফল ঘোষণার সময় প্রত্যেক প্রার্থী এবং তাদের কর্মী সমর্থকরা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণার সময় ভোটের সংখ্যায় ব্যাপক ভাবে এগিয়ে থাকায় আনারস প্রতীকের সমর্থকরা অডিটরিয়ামের মধ্যেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন। একেএকে ৫৪ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা শেষে রাত ৯টার দিকে প্রার্থীদের মোট ভোট এবং বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন অফিসার ইস্তাফিজুল হক আকন্দ। এসময় বাধভাঙা উল্লাসে উপজেলা পরিষদ মাতিয়ে তুলেন বিজয়ী প্রার্থী মাকসুদের কর্মী সমর্থকরা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, আনারস প্রতীক নিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া মাকসুদ পেয়েছেন মোট ২৯ হাজার ৮৭৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী এমএ রশীদ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮৩৮ ভোট। চিংড়ি প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আতাউর রহমান মুকুল পেয়েছেন ১২ হাজার ৬২২ ভোট। আর হেলিকপ্টার প্রতীক নিয়ে মাকসুদের ড্যামি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা তার পুত্র মাহমুদুল হাসান শুভ পেয়েছেন ২৫৫ ভোট।
এদিকে, ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হওয়া মাইক প্রতীকের প্রার্থী আলমগীর ১৭ হাজার ৬০৬ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ সানু উড়োজাহার প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৭ হাজার ১ ভোট। টিউবয়েল প্রতীকের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম জুয়েল পেয়েছেন ১৩ হজার ৪২৮ ভোট এবং মোশাইদ রহমান মুকিত তালা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৮ হাজার ৪০৬ ভোট।
আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ফুটবল প্রতীক নিয়ে পূনরায় বিজয়ী হওয়া ছালিমা হোসেন পেয়েছেন ২৯ হাজার ৪৫৬ ভোট। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মাহমুদা আক্তার কলস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২৬ হাজার ২৮৬ ভোট।
প্রসঙ্গত, বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৫৪টি ভোট কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৬৪। মোট ভোট পড়েছে ৬০ হাজার ৩৪০টি, শতাংশের হিসাবে যা ৪৫ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট। এর মধ্যে বৈধ ভোটের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৪৪১। আর বাতিল হয়েছে ৩ হাজার ৮৯৯টি।